কারাবন্দিত্বের একবছর পূর্ণ হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার – গণতন্ত্রের মা দেশমাতা খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই

কারাবন্দিত্বের একবছর পূর্ণ হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার। ২০১৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ৫ বছরের সাজার রায় দেন বিশেষ আদালত। রায়ের পরপরই কড়া প্রহরায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। আগেই পরিত্যক্ত ঘোষিত ওই কারাগারের ডে কেয়ার সেন্টারে শুরু হয় খালেদা জিয়ার কারাবাস। সেই থেকে পরিত্যক্ত ওই কারাগারে একমাত্র বন্দি হিসেবে দিন কাটছে তার।

২০১৯ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি একবছর পূর্ণ হয়েছে তার কারাভোগের। কারাগারে খালেদা জিয়াকে প্রথম ডিভিশন দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীকে রাখা হয়েছে সাধারণ কয়েদিদের মতো।’ বয়স বিবেচনা করে একজন সহায়তাকারী হিসেবে গৃহকর্মী ফাতেমাকে তার সঙ্গে থাকার সুযোগ দেয় কারা কর্তৃপক্ষ।

তবে বিভিন্ন সময় দলটির নেতা ও আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন ‘নির্জন কারাবাস বলতে যা বোঝায়, কারাবাসে খালেদা জিয়ার দিন কাটছে তেমন। খাবার থেকে আবাস কোনো ক্ষেত্রেই বিশেষ সুবিধা পাননি তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ৭৪ বছর বয়স্ক খালেদা জিয়া।’

ওয়ান ইলেভেন সরকারের আমলে দায়েরকৃত এ মামলায় সাড়ে ৯ বছর আইনি লড়াই করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। ২০১৪ সালে এ মামলায় অভিযোগ গঠনের পর মামলাটিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলা আখ্যায়িত করে বিএনপি। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক উত্তাপ গড়িয়েছিল আদালত পর্যন্ত। বিচারিক কার্যক্রমের শেষের দিকে মামলার কার্যক্রম চলে দ্রুত। এ সময় খালেদা জিয়াকে বকশিবাজারের কারা অধিদপ্তরের প্যারেড গ্রাউন্ডে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে হাজির হতে হয়েছে সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন।

নিম্নআদালতের রায়ের পর সে রায় বাতিল ও জামিনের জন্য উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। কিন্তু নিম্নআদালত থেকে রায়ের কপি উচ্চ আদালতে পৌঁছাতেই সময় লাগে বেশ কয়েকদিন। ১২ই মার্চ হাইকোর্ট চার মাসের জামিনের আদেশ দিলেও তার বিরুদ্ধে আপিল করে দুদক। চেম্বার জজ মামলাটি পাঠিয়ে দেন আপিল বিভাগে। আপিল বিভাগ তার জামিন বহাল রাখেন। কিন্তু ততদিনে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় কুমিল্লায় দায়েরকৃত একটি নাশকতার মামলায়। যে মামলায় খালেদা জিয়াকে করা হয়েছিল হকুমের আসামি। জিয়া অরফানেজ মামলায় ৫ দফা জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হলেও অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর কারণে আটকে যায় তার মুক্তির পথ। ৩০শে অক্টোবর উচ্চ আদালতে মামলাটির চূড়ান্ত রায় ঘোষণা হয়।

সেখানে নিম্নআদালতের দেয়া ৫ বছর সাজার রায় বাড়িয়ে ১০ বছর করেন হাইকোর্ট। তার আগের দিন ২৯শে অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেন বিশেষ আদালতের বিচারক। শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে কারাকর্তৃপক্ষ খালেদা জিয়াকে বকশীবাজার প্যারেড গ্রাউন্ডের আদালতে না আনায় চ্যারিটেবল মামলার চূড়ান্ত বিচার কার্যক্রমে পরিচালিত হয় কারাগারের অভ্যন্তরে স্থাপিত বিশেষ আদালতে। পরিবেশ ও নিজের শারীরিক অসুস্থতার কারণে বারবার কারাঅভ্যন্তরে স্থাপিত আদালতের হাজির হওয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহ পোষণ করেন। খালেদা জিয়ার কারাবন্দিত্বের একবছর পূর্ণ হওয়ার দিন গতকাল গ্যাটকো মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, কেবল ন্যায়বিচার হলেই হবে না- জনগণের কাছে প্রতীয়মান এবং জনমনে আস্থা জন্মাতে হবে যে ন্যায়বিচার হয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে দুটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে তিরিশের অধিক মামলা চলমান রয়েছে। প্রথম দুটি মামলায় সঠিক বিচার হলেও আমার ধারণা জনগণের একটি বিরাট অংশ এ মামলাগুলোতে ন্যায়বিচার হচ্ছে বলে মনে করছে না। বলাবাহুল্য, সরকার এবং সরকারি দলের সমর্থকদের কাছে ন্যায়বিচার হয়েছে বলে আস্থা জন্মেছে। এই যে দ্বিধাবিভক্তি এটা দেশে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতার পক্ষে বিরাট অন্তরায়। যতদিন জনগণের একটি বিরাট অংশ মনে করবে যে, বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে, ততদিন তার জনপ্রিয়তা বহাল থাকবে।

ওদিকে কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ দিতে অব্যাহত দাবি জানান খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও তার নেতৃত্বাধীন দল বিএনপির নেতারা।

কিন্তু কারাকর্তৃপক্ষ সে দাবি নাকচ করছে বারবার। পরে কারাকর্তৃপক্ষ সরকারি চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করে। সে বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী ২০১৮ সালের ৮ই এপ্রিল তাকে কয়েক ঘণ্টার জন্য নেয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। দুই মাস কারাভোগের পর প্রথমবারের মতো তাকে দেখা যায় জনসম্মুখে। তার জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করা হলেও তিনি গাড়ি থেকে নেমে হেঁটেই কেবিন ব্লকে যান। কয়েকটি এক্সরে করিয়ে সেদিনই তাকে ফেরত নেয়া হয় কারাগারে। এদিকে ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সরকারি চিকিৎসকদের পরামর্শ মতো ওষুধ সেবনে অনীহা প্রকাশ করেন খালেদা জিয়া। কারাগারে ধীরে ধীরে অবনতি ঘটে তার স্বাস্থ্যের। এক পর্যায়ে তার আইনজীবী ও দলের নেতাকর্মীরা বেসরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তি করে তার চিকিৎসার দাবি তোলেন। এমনকি তার চিকিৎসার খরচ বহনের ঘোষণাও দেন।

কিন্তু সে দাবি বারবার অগ্রাহ্য করে কারাকর্তৃপক্ষ। বিএনপির তরফে অভিযোগ করা হয়, ওয়ান ইলেভেনের সময় কারাবন্দি হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পছন্দমতো হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু এখন খালেদা জিয়াকে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ নিয়ে দীর্ঘ বাহাসের পর উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। বিএনপি নেতারা দাবি করেন ‘মাইল্ড স্ট্রোক’ হয়েছে খালেদা জিয়ার। এ সময় রিউম্যাটিকআর্থ্রাইটিসের কারণে হাত-পা ফুলে যায়, ফ্রোজেন শোল্ডার, পিঠে ব্যথা, চোখের সমস্যাসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। হাঁটতে অক্ষম হয়ে পড়ায় একবার তিনি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া পরিবারের স্বজনদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে পারেননি। তার শারীরিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার দাবি থেকে সরে আসে বিএনপি।

অন্যদিকে হাইকোর্টের নির্দেশে ৬ই অক্টোবর তাকে স্থানান্তর করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। তবে এবার গাড়ি থেকে নেমে হুইল চেয়ারে করেই তাকে নেয়া হয় ছয়তলার কেবিন ব্লকে। সেখানে ভর্তি করে তাকে কেবিন ব্লকের একটি ভিআইপি কেবিনে রাখা হয়। কেবিন ব্লকের ৬১২ নম্বর কেবিনে তার চিকিৎসা চলে পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের অধীনে। বিএনপির তরফে অভিযোগ করা হয়, মেডিকেল বোর্ড পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা মানা হয়নি। পরবর্তী দুই মাস সেই কেবিনেই চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। হাসপাতালের কেবিন ব্লকে ভিআইপি কেবিনগুলো দুই রুমের। কিন্তু একরুমে পাহারাদার কারারক্ষীরা অবস্থান করায় সেখানেও ছোট একটি রুমে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে খালেদা জিয়ার চলাচল। তবে কারাগারের চেয়ে কিছুটা পরিচ্ছন্ন পরিবেশ পান হাসপাতালে।

জেলখানার চেয়ে হাসপাতালের কেবিনে চিকিৎসাধীন এক মাস দুই দিন তিনি কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যে সময় কাটান। ওয়ান ইলেভেনের জরুরি সরকারের সময় এক বছরের বেশি সময় তিনি কারাভোগ করলেও সেবার শীর্ষ দুই নেত্রীকে রাখা হয়েছিল সংসদ ভবন কমপ্লেক্সের দুটি ভবনে। এদিকে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ৮ই নভেম্বর হাসপাতাল থেকে খালেদা জিয়াকে ফিরিয়ে নেয়া হয় কারাগারে। বর্তমানে তিনি পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডে কেয়ার সেন্টারে বন্দি রয়েছেন। কারাগারে নেয়ার পর থেকে তার পরিবারের সদস্যরা সপ্তাহে একবার দেখা করার সুযোগ পান। কারাগারে নেয়ার প্রথমদিকে ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে দুইবার বিএনপির নীতিনির্ধারক ফোরামের কয়েকজন তার সঙ্গে দেখার করার সুযোগ পান। তবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একা কয়েকবার দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন।

এদিকে কারাগারে যাওয়ার আগে নেতাকর্মীদের রাজপথ উত্তপ্তকারী কোনো আন্দোলন কর্মসূচি না দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। ফলে বিগত এক বছরে কয়েকটি মানববন্ধন, অনশন, স্মারকলিপি পেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচির মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে বিএনপি। অন্যদিকে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। কিন্তু সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দলীয় সরকারের অধীনে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে নিজের ইতিবাচক মনোভাবের কথা জানান দলটির নীতিনির্ধারকদের।

এমন কি কারাবন্দি অবস্থায় নির্বাচনে লড়ার জন্য তিনটি আসনে তিনি দলের প্রার্থীও হন। কিন্তু তার প্রার্থিতা বাতিলে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তটি উচ্চ আদালত বহাল রাখলে নির্বাচনে লড়তে পারেননি তিনি। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ কখনো দীর্ঘসূত্রিতা, কখনো অতিদ্রুততা, কখনো নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো আবার কখনো অন্য মামলায় জামিন বাতিলের কারণে তার জামিনে মুক্তির আইনি পথের প্রতিবন্ধকতা এখনো কাটেনি। কুমিল্লার একটি মামলায় অভিযুক্তদের সবাই জামিনে থাকলেও জামিন মেলেনি খালেদা জিয়ার। একাদশ জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তার কারামুক্তি।